গণহত্যা দিবসে রোহিঙ্গাদের বর্ডার ভেঙ্গে মিয়ানমারে ঢুকার হুঁশিয়ারি

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, এডভোকেট॥

ঠিক ছয় বছর আগে ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নারকীয় নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী,পুরুষ ও শিশুদের ঢল নেমেছিল বাংলাদেশে।

এই দিনটি স্মরণ করে গণহত্যা দিবস পালন করেছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে সমাবেশ করে হাজার হাজার আশ্রিত রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা এফডিএমএন রিপ্রেজেনটেটিভ বোর্ড মেম্বার মাস্টার ছৈয়দ উল্লাহ ঘোষণা করেছেন, আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমরা আরো জোর দাবি জানাবো। এরপরও যদি আমাদেরকে নিজের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে না যায় তখন আমরা আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নিয়ে বর্ডার ভেঙ্গে আমাদের দেশ মাতৃভুমি মিয়ানমারে ঢুকে যাবো।

একইভাবে গত জুন মাসেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ক্যাম্প এলাকায় শোভাযাত্রা ও মানববন্ধন করে নিজেদের ভাষায় জনপ্রিয় গানের সুরে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আকুতি জানিয়ে ’গো হোম’ কর্মসুচি পালন করে চারটি শর্ত দিয়েছেন।

শর্তগুলো হলো, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিকত্ব দিতে হবে; রাখাইন রাজ্যে ফেলে আসা জন্মভিটাতে তাদের পুণর্বাসন করতে হবে; স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দিতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের লুন্ঠিত সম্পদ ও জায়গা-জমি ফেরত দিতে হবে। সবগুলো দাবীই অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত,আর্ন্তজাতিক আইন ও সার্বজনিন মানবাধিকারের সাথে সংগতিপূর্ণ।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর প্রায় ৮ লাখ, আগে আসা ও নতুন করে জন্ম নেওয়া দেড় লাখ সহ বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। ঐ বছরই চীনের বিশেষ অতি আগ্রহে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকার তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশের সাথে তিন মাসের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তি করলেও বিগত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার। তালিকা দেওয়া, তালিকা নেওয়া, যাচাই বাছাই ইত্যাদি অজুহাতে পরিকল্পিতভাবেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজ শুরুই করতে দেয় নি।

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালতে বিচারাধীন মামলায় চাপ কমানোর জন্য বা মিয়ানমারের মোটিভ ভাল তা দেখানোর জন্য সম্প্রতি চীনাদের সাহায্যে পাইলট প্রকল্পে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেছেন। রোহিঙ্গা নেতাদের মিয়ানমারের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও পুণর্বাসন প্রস্তুতি সরেজমিনে দেখানোর জন্য মিয়ানমার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশের দেওয়া তালিকা থেকে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে মাত্র ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার সম্মতি দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমার ও চীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিকভাবে প্রতি মাসে ১০০০ জন করে রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন শুরু করলে বছরে ১২০০০ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব। কিন্তু প্রতি বছর ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে প্রায় ৩০হাজার রোহিঙ্গা সন্তান। তা হলে বর্তমানে বাংলাদেশে থাকা ১৪ লাখের সাথে আরো কয়েক লাখ জন্ম নিলে আগামী ১০০ বছরেও বাংলাদেশকে রোহিঙ্গামুক্ত করা যাবে না ভেবে কক্সবাজারবাসী খুবই হতাশ।

রোহিঙ্গারা প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিয়ে তালিকা করে তালিকা যাচাই বাছাই করে বাংলাদেশে আসেন নাই। প্রাণ বাঁচানোর জন্য যে যেভাবে পারেন সেভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছেন রোহিঙ্গারা।

তারা যেভাবে বাংলাদেশে এসেছেন সেভাবেই আবার মিয়ানমারে চলে যাবেন। এত তালিকা করার, যাচাই বাছাই করার, প্রতিনিধি দল আসা-যাওয়ার দরকার কি? শুধু সময়ক্ষেপন করা। এইখানে রোহিঙ্গাদের বসবাস দীর্ঘায়িত করা। আমাদেরকে মারাত্মক রক্তচোষা ’চীনাজোগ’ এ ধরেছে?

ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মিয়ানমারের পরিস্থিতিবিষয়ক বিশেষ র্যাপোটিয়ার টম অ্যান্ড্রুস। তিনি বলেছেন, মিয়ানমারে রাখাইনে এখনো রোহিঙ্গাদের জীবন ও চলাচলের স্বাধীনতা ঝুকিতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও বিবৃতি দিয়ে বলেছে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার ফিরে যাওয়া নিরাপদ নয়।

গত ২২জুন বাংলাদেশ প্রতিদিন ’প্রত্যাবাসন নিয়ে নতুন জোট রোহিঙ্গাদের’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় প্রত্যাবাসন নিয়ে অভিন্ন সুরে কথা বলতে মাঠে নেমেছে মতৈক্যের জোট ’আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স’ (এআরএনএ)। এ নতুন জোটের নেতৃত্বে রয়েছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় আরএসওর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা মাস্টার নুরুল ইসলাম। এ জোটের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ক্যাম্পের দুই জঙ্গি সংগঠন ইসলামী মাহাজ, জমিয়তুল মুজাহিদীনসহ কমপক্ষে ২০টি সংগঠন।

এর মধ্যে ১৯জুন তারা প্রথম শোডাউনও করেছে। নতুন জোট গঠন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট এক রোহিঙ্গানেতা বলেছেন সশস্ত্র আন্দোলন পরিহার করে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সকল রোহিঙ্গা সংগঠনকে সমন্বয় করে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করবেন তারা। ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে বড় সমাবেশ করা হয়েছিল। সেই সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আর্ন্তজাতিকভাবে পরিচিত রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহ।

কিন্তু কিছু দিন পরে প্রত্যাবাসনবিরোধীদের হামলায় মহিবুল্লাহ নিহত হন। মহিবুল্লাহ হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে এবং বর্তমানে অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য গ্রহন পর্যায়ে আছে। সেই মামলার আসামীরা আরসা সদস্য। নতুন জোটের সাথে জঙ্গি সংগঠন আরসা একাত্মতা ঘোষণা করার খবর পাওয়া যায়নি। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ ও টার্গেট কিলিং এ পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।

রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপগুলো নিজেদের ভাই আশ্রিত রোহিঙ্গাদের হত্যার খবর নিয়মিত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও তারা গণহত্যাকারী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একজন সদস্যকেও হত্যা করেছে মর্মে সংবাদ পাওয়া যায় নাই। তাদের অস্ত্র শুধু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। রোহিঙ্গা নেতারা ক্যাম্পে থেকে ইয়াবা/মাদক ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

তারা আরাকানে কেন ফিরে যাবেন? কক্সবাজারবাসীর বিশ্বাস চীন-মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক সকল কার্যক্রম আন্তরিকতাহীন, লোকদেখানো, প্রতারণামূলক ও বিশ্ববাসীকে ধোকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

ইতিমধ্যে মিয়ানমারের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অং সান সুচির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় দখল করে অং সান সুচিসহ তার দলের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করে রেখেছে জান্তা সরকার। সাধারণ নির্বাচনে জয়ী এনএলডির সংসদ সদস্যরা অন্যান্য দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্য সরকার গঠন করেছে।

জাতীয় ঐক্য সরকারের একজন মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে সেমিনারে বক্তৃতা দিয়েছেন। তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি অবিচার হয়েছে তা স্বীকার করে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে স্বসম্মানে মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জাতীয় ঐক্য সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বার্মা এক্ট নামের নতুন আইন পাশ করে ঐক্য সরকারকে সকল ধরনের সহযোগিতা করছে।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার মাত্রা বাড়াচ্ছে। জাতিসংঘে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয়েছে। জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্য সরকারের নেতৃত্বে গঠিত সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে অনেক এলাকা মুক্ত করেছে। আরাকান রাজ্যে আরাকান আর্মি অনেক এলাকা দখল করে নিয়েছে।

আরাকন আর্মিও রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যুদ্ধরত উভয় দল জান্তা বিরোধী যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের সহায়তা চেয়েছে। অপর দিকে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী গোপনে আরশাসহ তাদের চরদের দিয়ে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক রোহিঙ্গা নেতা ও মাঝিদের টার্গেট করে নিয়মিত হত্যা করাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের সামান্যতম দেশপ্রেম ও আত্মসম্মানবোধ থাকলে তাদের কক্সবাজার ক্যাম্পে নারী-শিশু ও শারীরিকভাবে অক্ষমদের রেখে বাকীদের গোপনে অঘোষিতভাবে আরাকান আর্মি ও ঐক্য সরকারের সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেওয়া উচিত।

তবে ২৫ আগস্ট ঘোষিত আশ্রিত সকল রোহিঙ্গা একসাথে বর্ডার ভেঙ্গে নিজেদের জন্মভুমি মিয়ানমারে প্রবেশ করার ঘোষণা বাস্তবে কার্যকরী করতে গেলে মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর ভুমিকা এবং চীন, রাশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া কি হয় তা দেখার জন্য আপেক্ষা করতে হবে।

  • লেখক
  • একজন কলামিষ্ট
  • সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার
  • বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।